শুক্রবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১০

লাশ বানিজ্য পদক-১

“করিম শেখ ।
প্রাইমারী স্কুলের একজন শিক্ষক। কিছু জমি জিরেত আছে। চাষবাস করে যৎসামান্য টাকা আসত। সে বছরটা প্রচন্ড খরা গেল, ফসল সব পুড়ে ছাই। স্কুলের বেতন কি আর নিয়মিত পাওয়া যায়! তার স্ত্রী একটা ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিয়েছিলেন। এই ব্যাংকে আবার মহিলাদের সদস্য হতে হয় এবং সেই সদস্যের নামেই ঋণ পাওয়া যায়।
করিম শেখের ধারণা ছিল, ফসল উঠলে কিস্তির টাকাসহ জমা দিয়ে দেবেন। করিম শেখ ফসলের মাঠের দিকে তাকিয়ে লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলেন! ব্যাংক থেকে লোক এসে বেশ ক-বার হুমকী দিয়ে গেছে, সময়মতো টাকা শোধ না দিলে এর পরিণাম ভালো হবে না।

করিম শেখ হুমকীর ভয়ে কাবু নন। ব্যাংকের লোকজনরাও নিশ্চয়ই খোঁজখবর রাখে, তিনি একজন শিক্ষক। ৭ গ্রামে তাকে ছাড়া কোন সিদ্ধান্ত হয় না। কিন্তু তিনি নিজেই লজ্জায় মরে যাচ্ছিলেন, মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছা করে! গ্রামে, স্কুলে জানাজানি হলে কি উপায় হবে! বাচ্চার মায়ের গায়েই বা ক-ফোঁটা গহনা! অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলেন জমি বিক্রি করে দেবেন, এ ছাড়া আর গতি নেই।

সে দিন ছিল হাটবার। করিম শেখ হাটে গিয়েছিলেন। ব্যাংকের লোকজনরা পুলিশসহ এসেছিল। করিম শেখের স্ত্রী বারংবার কাতর অনুরোধ করছিলেন, বাচ্চার বাপ বাড়ীতে নাই, হাটে গেছে; ফিরুক, নিশ্চয়ই কোন একটা ব্যবস্থা হবে।
এরা কান দিল না। ব্যাংকের লোকদের এক কথাঃ টাকা তো আমরা বাচ্চার বাপকে ধার দেই নাই তোমাকে দিয়েছি, তুমি পরিশোধ করবা।
করিম শেখের স্ত্রী এক্ষণ টাকা পাবেন কোথায়? সমস্ত গ্রামের মহিলারা এ বাড়ীতে জড়ো হয়েছেন; পুরুষরা বেশীরভাগই হাটে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে। মহিলাদের হা হুতাশে কান দেয় কে! এরা করিম শেখের একটা গরু , কয়েক বস্তা ধান, করিম শেখের স্ত্রীর হাতের সরু তারের দুইটা রুলি নিয়ে নিল।

ঝমঝম শব্দ। করিম শেখের ৬ষ্ট শ্রেণী পড়ুয়া কন্যা দৌড়ে আসলো। ঝমঝম শব্দের উৎস তার পায়ের নুপুর।
বাবা বড়ো শখ করে খেয়ে না খেয়ে গড়িয়ে দিয়েছিলেন। যে দিন বাজান এটা নিয়ে এসেছিলেন, সে দিন বাজান সুর করে বলছিলেনঃ কই রে আমার টুনটুনি, কই রে আমার ঝুনঝুনি; দেখ লো মা, তোর লিগ্যা কি আনছি। সে দিন তার চোখে তীব্র আনন্দে পানি চলে এসেছিল! নষ্ট হবার ভয়ে তুলে রেখেছিল। বাবা ছদ্মরাগে বলেছিলেনঃ আমার মা হাঁটে আওয়াজ পাই না ক্যা?

করিম শেখের কন্যা ব্যাংকের লোকের পা জড়িয়ে ধরলো। ব্যাংকের লোকদের ভাবান্তর হলো না এত কিছু দেখলে ব্যাংক চলে না, মাসিক টার্গেটেরই বা কি হবে? এদের নিজেদেরর মধ্যে চোখাচোখি হলো।
একজন বলেছিলঃ খুকি তোমার পায়ের নুপুরটা তো খুব সুন্দর তো, খুলে দাও তো, একটু দেখি। করিম শেখের কন্যা সরল মনে খুলে দিল। কিন্তু ওরা যখন অন্যান্য জিনিষের সঙ্গে এটাও নিয়ে গেল সে ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।
ভিড়ের মধ্যে তার স্কুলের মুখরা এক বান্ধবী বলেছিলঃ ভালা হইছে, স্কুলে এইটা পইরা গিয়া খুব রঙ্গ করতি, এহন রঙ্গ বাইর হইবো!
করিম শেখ সন্ধ্যায় ফিরে এলে, অনেক কিছুর সঙ্গে পাননি জমিতে দেয়ার জন্য ১টা কীটনাশক বোতল আর তার কন্যাকে।

গরমকাল। রাতের মধ্যেই জানাজা পড়ে কবর দিয়েছিলেন। মানুষটা শান্তই ছিলেন, চিৎকার চেঁচামেচি কিছুই করেননি। শুধু তার কন্যাকে কবরে নামাবার সময় একবার কাতর গলায় বলেছিলেনঃ আহা, একটু আস্তে কইরা নামাও না, মায়াডা দুকখু পায় না বুঝি! করিম শেখ নামের শান্ত মানুষটা আরও শান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। জমি বিক্রি করে শোধ করে শুধু নুপুরটা নিয়ে এসেছিলেন, আর কিচ্ছু আনেনি।

ব্যাংকের লোকজনরা অনেক পীড়াপীড়ি করেছে। করিম শেখ অবিচল। এমন কি একবার লোক দিয়ে এরা গরু, ধানের বস্তা গ্রামে করিম শেখের বাড়ীতে নিয়ে এসেছিল। জোর করে রেখে যাওয়ার চেষ্টা করলে, করিম শেখের মতো শান্ত মানুষটা বটি দা নিয়ে হিংস্রভঙ্গিতে বলেছিলেনঃ আমার চোকখের সামনে থিক্যা দূর হ, নাইলে একটা কোপ দিমু।

ছোট একটা পত্রিকার সাংবাদিক এসেছিল। করিম শেখ দেখা করতে, কথা বলতে রাজী হননি। অন্যদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে, ওই পত্রিকার মফঃস্বল বিভাগে খুব ছোট্ট করে এ খবরটা ছাপা হয়েছিল। গ্রামের ছেলেপুরেরা, তার ছাত্ররা বলেছিল, আপনে খালি একবার কন, ব্যাংক জ্বালায়া দিমু। করিম শেখ মাথা নেড়ে না করেছিলেন।

…প্রায় ২০ বছর পর। নামী এক পত্রিকার দুঁদে সাংবাদিক ঢাকা থেকে এসেছেন করিম শেখের সঙ্গে দেখা করতে। করিম শেখ দেখা করতেন না কিন্তু সঙ্গে এসেছে তার অতি প্রিয় ছাত্র, যে এখন ওই পত্রিকাতেই এখন চাকরী করে। এই সাংবাদিক অসম্ভব বুদ্ধিমান তিনি জানেন, এই নিউজের এই মুহূর্তে কী অপরিসীম মূল্য!
সাংবাদিক বললেন, ‘আপনার প্রতি ভয়াবহ অন্যায় হয়েছে। আমি আবার নতুন করে আপনার ওই খবরটা প্রথম পাতায় ছাপাতে চাই। আপনার মেয়ের ছবি থাকবে, সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎকার এবং ছবি।’
করিম শেখ বললেন, ‘এত্তো বছর পর আপনে এইটা নিয়া নাড়াচাড়া করতে চাইতাছেন ক্যান?’ সাংবাদিক খানিকটা থমকালেন, ‘অনেক বছর আপনি ন্যায় পান নাই… অনেক টাকাও আপনি পাবেন ।’
করিম শেখ তার ভারী চশমাটা মুছতে মুছতে বললেন, ‘বাবা, আমি একজন শিক্ষক, সামান্য লেখাপড়া জানি। বিষয় এইটা না, বিষয়টা হইলো গিয়া, যে ব্যাংক আমার প্রতি মহা অন্যায় করছিল ওই ব্যাংকের পরতিষ্ঠাতা অনেক বড়ো সম্মান পাইছেন। দুনিয়ায় আমাগো দেশের নাম আলোচনা হইতাছে। আমাদের মাথা অনেক উঁচা হইছে। আপনের পরতিকা চাইতাছে, ওই মানুষটারে কেমনে ছোড করা যায় কি বাবা, ভুল বললাম?’
সাংবাদিক তো তো করে বললেন, ‘আপনি কি আপনার মেয়ের কথা ভুলে গেছে, তার কথা ভেবে…।’

করিম শেখ এ প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। উঠে গিয়ে ভেতর থেকে গিট দেয়া একটা রুমাল নিয়ে এলেন। নিমিষেই ঘরময় ছড়িয়ে পড়লো ন্যাপথেলিনের সৌরভ। তিনি খুব যত্ন করে রুমালের গিট খুললেন। বেরিয়ে এলো কালচে রুপার ১টা নুপুর। করিম শেখ রুমাল দিয়ে অযথাই ঘসে ঘসে নুপুরটা চকচক করার চেষ্টা করছেন। তার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ে নুপরটা ভিজে যাচ্ছে। করিম শেখ ভাঙ্গা গলায় বললেন, ‘দেশের সম্মানের থিক্যা বড়ো কিছু আর নাই। দেশের লাইগ্যা আমার ১টা মাইয়া কুরবানী দিলেই কী’!”

লেখাটি দিয়ে তোপের মুখে পড়েছিলাম। অনেক মন্তব্যের একটা নিয়ে বলি। হুবহু মন্তব্যটা, দাঁড়ি-কমাসহ, এখানে তুলে দিচ্ছি: “শুভ, চলেন, নোবেল কমিটিকে চিঠি দেই নোবেল প্রত্যাহারের জন্য। আপনি লিখে দেন, পোস্টেজ খরচ আমার”।
হা হা হা। প্রবাসী ওই মানুষটার শ্লেষ আমি খানিকটা ধরতে পারি। কালচে সবুজ রঙের পাসপোর্টটা নিয়ে শুভকে তো আর এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করতে হয় না। কালেভদ্রে, পাঁচ বছর পরপর পাসপোর্টটা বার করি রিনিউর জন্য, কোথাও যাওয়াই হয় না। (একবার ১টা ফ্রি টিকেট পেলাম, হোটেলের খরচসহ। ব্যাটারা আমার কাছে জানতে চাইল, কই যাইতে চাও? মালেয়শিয়া, না ব্যাংকক। আমি হাঁই তুলে বলি, দেখি। আমার দেখাদেখির পর্ব আর শেষ হয় না। মনে মনে ভাবলাম, ধ্যাত, ফ্যা-ফ্যা করে একা একা কোথায় ঘুরব। আফসোস, ওই টিকেটে এখন আর প্লেনে বসে যাওয়ার সুযোগ নাই- প্লেনে দাঁড়িয়ে গেলে সম্ভবত মানা করবে না- সিস্টেমটা সম্ভবত এখনও চালু হয়নি! )
তো, প্রফেসর ইউনুসের নোবেল প্রাপ্তি নিয়ে জোর তর্ক-বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু এই একটা জায়গায় অভাবনীয় এক কান্ড ঘটে গেছে। বৈদেশীরা যখন কালচে সবুজ পাসপোর্টটার দিকে চোখ কুঁচকে তাকান আমাদের প্রতি অযথাই কালচে করে রাখা এদের মুখগুলো খানিকটা কমনীয় হয়ে উঠে। এই একটা মানুষ, এই অযাচিত সম্মানটা আমাদের এনে দিয়েছেন। ক্ষণে ক্ষণে সেলাম ঠুকেও আসলে এ ঋণ শোধ হয় না। এটা যে কী পাওয়া ভুক্তভোগী ব্যতীত অন্যদের অনুমান করতে পারা খানিকটা দুরূহ বটে।
তবে এও সত্য, ঝলসে ওঠা আলোর পেছনের অন্ধকারের কথা না বললেও অন্যায় হয় বৈকি। গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্যের পাশাপাশি অনেক অন্ধকার দিক আছে।

সত্য ঘটনা অবলম্বনে এই লেখাটি লেখা হয়েছিল। মূল ঘটনা সত্য- মেয়েটি দুর্দান্ত অভিমানে আত্মহত্যা করেছিল। মেয়েটার নিথর দেহটা আমার নিজ চোখে দেখা। ক-রাত ঘুমের খুব সমস্যা হয়েছিল।

ফিকশনের জন্ম রিপোটিং-এর গর্ভে। এ লেখাতেও খানিকটা ফিকশন ছিল বৈকি। তখন বিভিন্ন ভাবে প্রফেসর ইউনুসকে অপদস্ত করার চেষ্টা ছিল। সলাজে বলি, আমার স্পষ্ট কিছু বক্তব্য ছিল, মানুষটার প্রতি, মাস্টারের কিছু কথায়- অন্তত শেষ অংশে। পুরনো মদ- সেলার থেকে বের করলে খুব একটা অন্যায় হবে বলে মনে করি না বলেই পুরনো লেখাটা এখানে তুলে দেয়া। আমার প্রিয় লেখা।  
সূত্র-আলী আহমেদ 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন