রবিবার, ২০ জুন, ২০১০

ডিজিটাল আব্বা

> আজ আমি আপনাদের সাথে এক টা ডিজিটাল গপ্পো শেয়ার করুম।রেডী হইয়া লন।গপ্পো টা
> যারা
> পরে নাই তাদের জন্য।
>
> …………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
>
> ডিজিটাল আব্বা – আনিসুল হক
>
> ডিপার্টমেন্টের হেডস্যার বললেন, 'নেক্সট সেমিস্টারে তোমার আর কন্টিনিউ করার
> দরকার
> নাই। তুমি অন্য কোথাও দেখো।'
>
> আমি বললাম, 'স্যার, আর কোথায় দেখব! এত ভালো একটা ইউনিভার্সিটি আমি ছাড়ব না।
> আর
> আপনার মতো টিচার! আমাকে লাস্ট চান্স দেন, স্যার।'
>
> 'গতবার আমি তোমাকে লাস্ট চান্স দিয়েছি। লাস্ট চান্স কয়বার হয়?' স্যারের
> মুখে মৃদু
> হাসি।
>
> 'এবিসি স্যার (মানে আবুল বাশার চৌধুরী) তো স্যার, আমাকে তিনবার লাস্ট চান্স
> দিয়েছেন।'
>
> হেডস্যার হাসলেন, 'তুমি টার্ম ফি দাও নাই। অ্যাবসেন্ট ছিলা প্রায় সব দিন।
> ফাইন দিয়ে
> এডমিশন নেওয়ার ডেটও পার হয়ে গেছে।'
>
> 'ব্যাক ডেটে নেন, স্যার।'
>
> 'তুমি এক কাজ করো। তোমার আব্বাকে ডেকে আনো। উনি এসে যদি বন্ড দেন, তাহলেই
> তোমাকে
> আমরা পরের সেমিস্টারে অ্যালাউ করব। যাও।' স্যারের হাসি মিলিয়ে গেল। তাঁর
> মুখটা কঠিন
> মনে হচ্ছে। আমি ঘামছি। অথচ স্যারের রুমে এয়ারকন্ডিশনার। মাথার ওপরে ফ্যানও
> ঘুরছে।
>
> আব্বা আসলে নিয়মিত টাকা দিয়েছেন। টার্ম ফি, সেশন ফি। আমি সেসব ভার্সিটিতে
> জমা
> দিইনি। এখন আব্বাকে কীভাবে বলব, আপনাকে স্যারের সঙ্গে দেখা করতে হবে। এটা
> অসম্ভব।
> এর আগে আব্বা আমার কাছে টাকা জমা দেওয়ার রসিদ চেয়েছেন। সেটা বানিয়েছি। রসিদ
> বানানো
> খুব সোজা। কম্পিউটারে বানিয়ে লাল-হলুদ কাগজে প্রিন্ট নিলেই হলো। পরীক্ষার
> প্রগ্রেসিভ রিপোর্ট চেয়েছেন। সেটাও বানিয়ে নিয়ে গেছি। আব্বা জানে আমার ফিফথ
> সেমিস্টার চলছে। আসলে আমার অবস্থা খুবই খারাপ। থার্ড সেমিস্টার পার হতে
> পারছি না।
>
> আচ্ছা, এত কিছু যখন নকল করতে পেরেছি, একটা আব্বাও নকল করতে পারব। আমাদের
> বন্ধুদের
> মধ্যে আছে মোস্তফা কামাল, তাকে দেখতে লাগে বাবা-বাবা। সে একটা গ্রুপ
> থিয়েটারে নাটক
> করার চেষ্টা করছে। কাজেই সে পেশাদার অভিনেতা। আপাতত আমার আব্বার চরিত্রে
> তাকে অভিনয়
> করতে হবে।
>
> কামালকে নিয়ে গেলাম স্যারের কাছে। 'স্যার, আব্বা এসেছেন, স্যার।'
>
> 'আপনার ছেলে যে ক্লাস করে না আপনি জানেন?' স্যার বললেন।
>
> মোস্তফা কামাল বিব্রত হওয়ার ভঙ্গি করে বলল, 'হারামজাদা! তুমি বাপের নাম
> ডুবাবা।
> ক্লাস করো না, রোজ বাইর হও সাইজা-গুইজা, কই যাও?'
>
> আমি বলি, 'আব্বা, গালি দিচ্ছেন কেন? এটা আমার ভার্সিটি, উনি আমাদের
> হেডস্যার।
> ভদ্রতা বজায় রাখেন।'
>
> 'হারামজাদা, তোকে আজ মাইরাই ফেলব। তুমি ক্লাস করো না!' মোস্তফা পায়ের
> স্যান্ডেল
> তুলছে। (হারামজাদা, এইটা ওভারঅ্যাক্টিং হইতেছে। তুই খালি বাইরা, তোরে আজকা
> খাইছি।)
>
> স্যার ভীষণ বিব্রত। বললেন, 'না, না। আপনি শান্ত হোন। আপনার ছেলে তো টার্ম
> ফিও দেয়
> না!'
>
> 'টার্ম ফি দেয় না! হারামজাদা পড়াশোনা করে না, এইটার মানে বুঝলাম। কিন্তু
> টাকা তো
> আমি অরে নিয়মিত দেই। টার্ম ফি দেস নাই ক্যান, ওই …'
>
> আমি কাঁচুমাচু হয়ে বলি, 'খরচ আছে না!'
>
> মোস্তফা আমার কান ধরে বসে। (হারামজাদা বাইরে আয়। তোর কান যদি আমি টেনে
> লম্বা না
> করছি!)
>
> এই সময় স্যারের কাছে ফোন আসে। স্যার ধরেন, 'হ্যালো। জি, জামান সাহেব, একটু
> ব্যস্ত।
> আপনার প্রিয় ছাত্রকে নিয়েই বসেছি। আসবেন? আসেন।'
>
> জামান সাহেব আসছেন। স্যার ফোন রেখে মোস্তফার দিকে তাকিয়ে বলেন, 'আপনার
> সঙ্গে নাকি
> জামান সাহেবের পরিচয় আছে। আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যই আসছেন।'
>
> আমি প্রমাদ গুনি। মোস্তফার সঙ্গে জামান স্যারের পরিচয় আছে, নাকি আব্বার
> সাথে! দুটোই
> সমান বিপদ ডেকে আনবে।
>
> 'স্যার, আমরা আসি। আব্বার কাজ আছে। আব্বা, তোমার না কাজ?'
>
> মোস্তফাটা একটা গাধা। বলে, 'না তো, কাজ আবার কী। তোরটা এস্পার-ওস্পার না
> কইরা
> ছাড়তেছি না। প্রফেসর সাব, আমার ছেলেরে আপনার হাতে তুইলা দিলাম, আপনি
> মারেন-কাটেন,
> খালি নামটা কাইটেন না।'
>
> ততক্ষণে জামান স্যার এসে হাজির। 'কই, হাশেম সাহেব কই?'
>
> 'এই যে হাশেম সাহেব।'
>
> জামান স্যার বলেন, 'উনি তো হাশেম সাহেব নন!'
>
> আমি বলি, 'স্যার। ইনিই হাশেম সাহেব। আমার আব্বা।'
>
> জামান স্যার বলেন, 'তোমার আব্বাকে আমি খুব ভালো করে চিনি। তার সঙ্গে আমি
> একসঙ্গে
> মালয়েশিয়া গিয়েছিলাম।'
>
> আমি বলি, 'স্যার, আমার আব্বাকে আপনি কী করে চিনবেন! হাশেম সাহেব নামে তো কত
> লোকই
> আছে ঢাকায়। আর তার ছেলের নাম হাসনাত হতেই পারে।'
>
> 'কিন্তু তোমার আব্বা সঙ্গে যে মুভি ক্যামেরাটা নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে
> তোমাদের
> পারিবারিক ভিডিও অনেক দেখেছি। হাসনাহেনা তোমার বোন তো? তার সঙ্গে আমার
> ছেলের বিয়ের
> কথাও অনেক দূর এগিয়েছে।' (ইস, আমি ফ্যামিলির খবর কিছুই কেন রাখি নাই!)
>
> মোস্তফা উঠে পড়েছে। সে কি পালাতে চায়!
>
> আমি ছাড়ার পাত্র না। খড়কুটো আটকে ধরার মতো করে বলি, 'না, হাসনাহেনা বলে
> আমার কোনো
> বোন নাই। আপনি, স্যার, ভুল করছেন।'
>
> স্যার বলেন, 'হাশেম সাহেব, আপনার স্ত্রীর নামটা বলুন তো। আমাদের ফরমে ছেলের
> পিতা-মাতা
> দুটো নামই লিখতে হয়। আমার সামনে কম্পিউটারের পর্দায় ওর বাবা-মা সব নামই
> আছে। নিজের
> স্ত্রীর নাম বলতে পারেন না?'
>
> আমি বলি, 'গুলশানারা। আব্বা বলো। আব্বাদের আমলে স্বামীর নাম, স্ত্রীর নাম
> মুখে আনতে
> মানা ছিল।'
>
> মোস্তফা কামাল ধপাস করে পড়ে যায়। চোখ থেকে তার চশমা ছিটকে পড়ে। এই
> হারামজাদার
> আরেকটা সমস্যা আছে। সে চশমা ছাড়া দেখতে পায় না।
>
> আমি দিলাম এক দৌড়। থাক হারামজাদা, অভিনয় পারিস না, স্ক্রিপ্ট মুখস্থ নাই,
> তোর ঠেলা
> তুই সামলা!
>
> এবার আরেকজনকে আব্বা বানাতে হবে। তার আগে জামান স্যারকে সরাতে হবে অকুস্থল
> থেকে।
> আমার বোন হাসনাহেনাই সেটা পারবে। আমি বলি, 'আপুসোনা, একটা কাজ করে দাও না।
> তোমার
> হবু শ্বশুর জামান স্যারকে একটু এনগেজড রাখো।'
>
> ব্যবস্থা পাকা। জামান স্যার এখন গেছেন ইউনাইটেড হাসপাতালে পুরো শরীর চেকআপ
> করাতে।
> হাসনাহেনা দাঁড়িয়ে থেকে নিজে থেকে তাঁকে সবগুলো টেস্ট করাচ্ছে।
>
> এবার আমাদের বন্ধুর মামা নাট্যশিল্পী মশিউল আলম গেছেন আমার আব্বা সেজে।
> মশিউল বললেন,
> "জামান সাহেবের কাছে আমি সব শুনেছি। আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। গুলশানারাও তো
> লজ্জায়
> মুখ দেখাতে পারছে না। বলছে, 'তোমার কী ছেলে পেটে ধরেছি।' এই হাসনাত, আর
> কোনো দিন এই
> রকম করবি?"
>
> আমি বললাম, 'না আব্বা। আরও? যা শিক্ষা হবার হয়ে গেছে।'
>
> 'মনে থাকে যেন …'
>
> বলার সঙ্গে সঙ্গে আমার অরিজিনাল আব্বা হাশেম সাহেব ও আমার অরিজিনাল আম্মা
> গুলশানারা
> পাশের ঘর থেকে এসে উঁকি দিলেন। স্যার নিজেই ফোন করে তাদের আগে থেকে ডেকে
> এনে পাশের
> রুমে বসিয়ে রেখেছিলেন। আজকালকার টিচারগুলান এই রকম ফাজিল প্রকৃতির হয়ে
> থাকে! বলেন,
> এই দেশ কীভাবে ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করবে, যদি শিক্ষক ও অভিভাবকেরা ছাত্রদের
> সহযোগিতা না করে?
>
> মশিউল টের পায়নি, বলেই চলেছে, 'ওর মা তো সারা দিনরাত কাঁদছে। নকল আব্বা
> বানিয়েছে
> ছেলে …।'
>
> কান্নার শব্দ উঠল। আমি তাকিয়ে দেখলাম আমার সত্যিকারের আম্মার চোখে
> সত্যিকারের জল।
>
> {গল্প টি প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যা (ঈদ-উল-ফিতর 2009) থেকে সংগৃহীত}
>
> ভাল লাগলে কমেন্টাইয়েন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন