শুক্রবার, ৮ এপ্রিল, ২০১১

মানুষ খেকো দানব

এস.এস.সি পরিক্ষা শেষকি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না? একদিন আম্মা বলল চল সইয়ের বাড়ী থেকে বেড়িয়ে আসিআমি, আম্মা, বদরুল, হাদীমামা সবাই মিলে কিশোরগন্জের পাকুন্দিয়া আম্মার সইয়ের বাড়ী বেড়াতে গেলামহৈ হৈ রৈ রৈ করে দিনগুলো খুব ভালই কাটছেএর মাঝে একদিন ঐ এলাকায় মাইকে প্রচার হচ্ছে যাত্রা হবেআমরা খুবই উৎফুল্লরাত্রে আমি, মামা, নয়ন ভাই, স্বপন, শরিফ, আরও তিনজন মিলে রওনা হলামমোটামুটি তিন কি.মি. রাস্তাতার মাঝে নাকি আবার নদী পার হইতে হয়

প্রচন্ড শীতখোলা গলায় গান ছেড়ে নদীর পাড় দিয়ে চলছিপাশের ঘন কাশবনের ফাক দিয়ে মাঝে মাঝে একজোড়া...দুই জোড়া চোখ এসে উকি দেয়উকি দিয়েই শেয়াল গুলো পাশের ঝোপে হারিয়ে যায়
মামা বলল শেয়ালেরা রাত্রে নদীর পাড়ে আসে কাকড়া খাওয়ার জন্য

আমরা মূল নদীরঘাটে এসে পৌছালামদেখি মাঝি নাই কিন্তু নৌকা আছেআমরা মাঝিকে ডাকাডাকি করতে লাগলে কিছুক্ষণ পর মাঝিকে দেখলাম কাশবন থেকে বেড়িয়ে আসলকিছুটা অপৃকতস্থ কি লেগেছিল? মনে নাইনদী পার হলামআরও এক কিলোমিটার

এবার কিন্তু সোজা কাশবনের ভিতর দিয়ে যেতে হবেছোট একটা রাস্তাবোঝাই যাচ্ছে এটা একটা কাশবনই ছিলমানুষ হাটতে হাটতে কিছুটা রাস্তা হয়েছেহালকা চাদনীদুইধারের কাশের জন্য দু্ইপাশে কিছুই দেখা যাচ্ছেনাশুধু সামনে আর পিছনে দেখা যাচ্ছেকিন্তু সামনে আর পিছনের দুইপাশে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকারকেননা চাদের আলো এতনিচে এসে পৌছাচ্ছেনাআমরা সবাই হাটছি তো হাটছিইকুয়াশা পরে দুইপাশের কাশগুলো কিছুটা নুয়ে পড়েছেফলে হাটার সময় আমাদের মুখে এসে লাগছেখুবই বিরক্তিকর একটা ব্যাপার

অনেকক্ষণ যাবৎ আমি একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম যে কিছুক্ষণ পর পরই কাশবনের ভিতর একটা শব্দ হচ্ছেশেষবার যখন শব্দটা শুনলাম তখন আমার মনে হলো কিছু একটা আমাদের সাথে সাথে চলছেআর কিছুক্ষণ পরপর শব্দটা শুনিয়ে কি বুঝাতে চাচ্ছে বুঝলাম নাতবে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর একই শব্দটা শোনা যাচ্ছেবন-জঙ্গল পরিষ্কার করে করে সামনে যাওয়ার যে শব্দটা ঠিক সেই রকমআমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলামতবে কারও কাছে কিছু বললাম না
সোজা সামনে হাটছি


থেকে থেকে শব্দটা আমি ঠিকই শুনতে পাচ্ছিএকটা জিনিস খুব অদ্ভুত লাগছিল যে সবাই কেমন জানি নির্বিকার, কেউ কি কিছু শুনতে পাচ্ছেনাতাহলে আমি কি কোন হ্যালুসেশানে আছিমানুষের চেচামেচি শোনা যাচ্ছেআমি আর মামাছাড়া আর বাকি সবাই দেখি দৌড় দিলআমরাও পিছনে পিছনে দৌড় লাগালাম

মোটামুটি সামনেই বসলামসবাই চিৎকার-চেচামেচি করছেদুইঘন্টা.........এরমাঝে আয়োজকদের একজন এসে বলে গেল চুপ করার জন্য এখনি নাকি যাত্রা শুরু হবে৫-১০ সেকেন্ট চুপ ছিল আবার চিল্লা-চিল্লিএবার স্থানীয় চেয়ারম্যানের অনুরোধসবাই চুপ 

নুপুরের আওয়াজ শোনা যাচ্ছেবাদ্যযন্ত্র বেজে উঠলনাচ শুরু হবে মনে হচ্ছেসে কি নাচ........নাচের তালে তালে দর্শকরা সবাই উন্মাতালমামার দিকে তাকিয়ে দেখি বসে বসে লাফাচ্ছেমামা আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা লজ্জা পেলকেউ কেউ টাকাও ছুড়ে মারছেনৃত্যশিল্পী টাকা কুড়িয়ে ব্লাউজের ফাক দিয়ে বুকে রাখছে আর গা থেকে ধীরে ধীরে কাপড় খুলে ফেলছেমামাকে দেখি বসা থেকে দাড়িয়ে দাড়িয়ে লাফাচ্ছেএদিকে দর্শক সারি থেকে কে জানি কাগজ দিয়ে বল বানিয়ে নৃত্যশিল্পীর গায়ে মারলশিল্পী কিছুটা বিব্রত বোঝাই যাচ্ছে

আয়োজককারীদের মধ্য থেকে একজন এসে অনুরোধ করে যাচ্ছে শৃঙ্খলা বজায় রাখতেঅহেতুক জামেলা কার সহ্য হয়? কেউ একজন ঐ আয়োজককারীর গায়ে জুতা ছুড়ে মারলসেচ্ছাসেবক দলের আট-দশজন মিলে একটা লোককে সনাক্ত করে মাইর শুরু করলসাথে সাথে দর্শকরাও ঝাপিয়ে পড়লমুহুর্তের মাঝেই হাজার হাজার মানুষ দৌড়াদৌড়ি শুরু করলশরীফ, স্বপন বলল মামা দৌড় দেন....বিরাট মাইর লাগব.......এই এলাকা খুব খারাপ
আমরা দৌড় লাগালাম

শরীফ, স্বপনরা সামনে দিয়া আমরা পিছনেদৌড়াচ্ছিতো... দৌড়াচ্ছিতো...পিছন দিয়া ধর ধর....জইল্যারে ছাড়িসনা.........মজিত্যা কই? এরকম হাজারও চিৎকার কানে ভেসে আসছেপিছনে তাকিয়ে দেখি হাজারও মানুষ দ্বিক-বেদ্বিক হয়ে দৌড়াচ্ছেআমরা তখন রাস্তাছেড়ে কাশবনের ভিতর দিয়া হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে আগাচ্ছিমামার জুতা ছিড়ে গেছেবেচারা ঐ জায়গায় বসে জুতার জন্য শোক করা শুরু করলমামা আবার ভীষন কৃপণতোআমরা মামাকে ধরে টেনে হিচড়ে ভিতরে যাচ্ছিধীরে ধীরে ধর ধর আওয়াজটাও স্তিমিত হয়ে আসছে

আমরা নদীরপাড়ে এসে দাড়ালামহালকা চাদনিঘাটে কেউ নেইসহজেয় বুঝতে পারলাম ভয়ে কেউ এদিকটায় আসেনিশরিফ বলল এখানে দাড়ানো মোটেও নিরাপদ নয়যে কোন ভাবেই নদীপাড় হতে হবেআমি আবার সাতার জানিনামামা বলল ভাগ্নে তুমি আমার কাদে উঠআমি রাজি হলামনাআমি সারাজীবন সব জায়গায় মাতব্বরি করতাম শুধু পানি ছাড়াকেননা হাজার চেষ্টা করেও যে সাতারটা শিকতে পারলামনাআমার সবসময় ভয় বেশী পানিতে গেলে নিচ দিয়ে যদি কেউ টান দেয়সবাই আমাকে অনেক বুঝানোর পরও রাজি হলাম নাসবাই নদীর পাড়ে দাড়িয়ে আছিএকটা অজানা আতংক সবার ভিতরে কাজ করছে

আল্লাহু... আল্লাহু... সবাই একটু ছড়ানো-ছিটানো থাকলেও দেখলাম মুহুর্ত্তের মাঝে একসাথে জড়ো হয়ে গেলশব্দটার উৎপত্তি বুঝার চেষ্টা করতে লাগলামএর মাঝে শুনলাম 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু....কাশবনের ভিতর দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে সে দিকে একটা ক্ষীণ আলোর রেখা কাশবনের উপরদিয়ে দেখা যাচ্ছেআমরা সবাই সেদিকে তাকিয়ে রইলামআলোর তীব্রতা এবং শব্দের তীব্রতা বেড়েই চলছে


সবাই একদৃষ্টিতে ঐ দিকে তাকিয়ে আছিদেখি দুইজন মানুষ ঐ কাশবনের পথ দিয়ে বের হয়ে আসছেদুইজনের হাতে দুইটি হারিকেনপিছনে চারজনে কাদে করে একটি খাটিয়া নিয়ে আসলোসাদা কাপড়ে ঢাকাবুঝলাম কোন লাশ নিয়ে এসেছেতার পিছনে আরও দুইজন হারিকেন হাতেঅবাক হয়ে গেলাম

আসসালামু ওয়ালাইকুমসবাই সালামের জবাব দিলামসবার চোখে-মুখে উৎকন্ঠা স্পষ্টআমি একটু আগ বাড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কি ব্যাপার বলুনতোসবচেয়ে বৃদ্ধ যে লোকটা সে বলল "মৃত ব্যাক্তিটি হলো এই এলাকার জামাইশশুর বাড়ীতে এসেছিলসাপের কামড়ে সন্ধায় মৃত্যু হয়েছেএখন ঐ পাড়ে নিজ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে দাফনের জন্য।" সবার জড়তা মনে হয় একটু কাটল 

-
বাবা নৌকা নাই
-
না চাচা দেখি না তো
-
ঠিক আছে তাহলে আপনারা এইখানে লাশের পাশে দাড়ান আমরা গিয়ে নৌকা নিয়ে আসছি

এইটা কি কয়? মাথাটা আবার ঝিনঝিন করে উঠলএকটু সন্দেহও লাগছিলশেষে আমি বললাম আপনারা চারজন এবং আমর চারজন মিলে গিয়ে নৌকা নিয়ে আসবআর বাকি সবাই এখানে থাকুকচাচা মনে হয় আমার মনের কথা বুঝতে পারলচাচার মুখে যে হাসিটা দেখলাম সেই হাসির রহস্য হাজার রকমের হতে পারে

আমরা আটজন মিলে রওনা হলামনদীর পাড়ে ধরে হাটছিসাথে দুইটি হারিকেনচাচা মনে হয় মাঝির বাড়ি চিনেসেই দেখলাম চিনিয়ে চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছেএকটা জায়গায় এসে চাচা থামলটর্চলাইট মেরে দেখলাম ঘাটে ঐ বিশাল নৌকাটা বাধা আছেজায়গাটা অনেক অন্ধকারনদীর পাড়ের উপরে বাড়ি ঘরও আছেকিন্তু মনে হচ্ছে যেন মৃত্যুপুরীকিছুটা ভয় ভয় লাগছেএকটা প্যাচা উড়ে গেলপানিতে কিছু পড়ার শব্দঐ হাইল্যা... হাইল্যারে........বুঝতে পারলাম মাঝির নাম হালিমকোন সারাশব্দ নাইচাচা রাগে বলতে লাগল সবাই কি মইরা ভূত হয়ে গেছেশেষে আমরাই নৌকা নিয়ে আসলাম 

অনেক বড় নৌকানৌকার ছাদ নেইউপরে কাঠ দিয়ে মেঝে করা হয়েছেতবে মাঝখানে চার হাতের মত জায়গা ফাকাপানি সেচের সুবিধার জন্য এটা করা হয়আমরা এই ফাকের এক পাশে বসলামঅন্য পাশে ওরাআমি নৌকার শেষ মাথায় বসলামনৌকা যখন ছাড়বে, ঠিক তখনি কাশবনের ভিতর থেকে একটা আওয়াজ আসল 

-
বাবারা আমারে একটু নিয়া যাও

টর্চ লাইট মেরে দেখি এক বৃদ্ধলোকভাবলাম এতরাত্রে আমরা নিয়া না গেলে বেচারা কিভাবে পার হবে? তাই আমিই সবাইকে অনুরোধ করলাম নেওয়ার জন্যনৌকাটি ভাসিয়ে লোকটি লাফ দিয়ে নৌকায় উঠলনৌকাটি দোলনার মত দোল খেতে লাগলআমার কাছে মনে হলো সবাই নৌকায় উঠার পর নৌকাটি যতটুকু ডুবল ঐ লোকটি উঠার পর আরও বেশী ডুবললোকটি লাশের ঠিক পায়ের কাছে বসলনৌকা চলতে লাগল

খুব বেশী বড় নদী নাকিছুটা স্রোত আছেমনের ভিতর অজানা আশংকটা যতই ভুলে থাকার চেষ্টা করছি ততই মনে পড়ছেএই হালকা চাদনী রাতে কাশবনের উপরে কুয়াশার ধোয়া যে মায়াবী জাল সৃষ্টি করেছে তা আলিফ লায়লার কথা মনে করিয়ে দিলভয় কাটানোর জন্য মনে মনে গান গাওয়ার চেষ্টা করলামজোরকরেই কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে যেতে চাইলামদূরে ভেসে যাওয়া কলাগাছরুপী লাশগুলোকে একমনে দেখছিলাম

হঠাৎ যে নৌকা চালাচ্ছিল তার বিকট চিৎকারকেউ একজন পানিতে ঝাপিয়ে পড়ার শব্দআমি ঘুরে তাকাতে তাকাতেই সমস্ত নৌকাটা দুলে উঠল যেন কোন নীলদড়িয়ায় নৌকাটি ঝড়ের কবলে পড়েছেসবাই লাফিয়ে পানিতে পড়ছেমামা চিৎকার করে পানিতে লাফ দেওয়ার জন্য বলছেআমি উঠে দাড়ালামনৌকার শেষমাথায় টর্চলাইট মেরে দেখি বৃদ্ধটি লাশের একটি পা ধরে পা'র মাংস খাচ্ছেপায়ের হারটি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিবৃদ্ধটির মুখে আলো পড়তেই আমার দিকে তাকিয়ে রইলোচোখ থেকে নীলআলো বিচ্ছুরিত হচ্ছেমুখে রক্তের দাগের মত এ্যাবরো-থেবরো মাংস লেপটানোবিবৎস দৃশ্যখুব বমি আসতে লাগলআমি জোড়করে চেষ্টা করছি সবকিছু আটকিয়ে রাখতেতীরের দিকে তাকালামবুঝতে পারছি এতটুকু সাতার দিয়ে পার হওয়া আমার পক্ষে সম্ভবনাসবাইকে দেখলাম চিৎকার করছে আর দৌড়াচ্ছেআমি বৃদ্ধের দিকে টর্চলাইট মেরে দাড়িয়ে রইলামবৃদ্ধটি আমার দিকে তাকালো...... উঠে দাড়ালো.....ঝপাৎ

যতক্ষণ পারলাম সাতার কাটতেই থাকলামশেষে মাটি হাটুতে বাজলবুঝতে পারলাম তীরে এসে পৌছেছিদৌড় লাগালামচিৎকার অনুসরণ করে কাশবনের ভিতর দিয়ে দৌড়াতে লাগলামহাজার-হাজার মানুষের চিৎকারচারদিকে মশাল আর মশালকেউ কেউ ডাকাত ডাকাত করেও চিল্লাচ্ছেকাশবনের ঐ পাশেই একটা বাড়ী আছে সেখানে সবাই পরে রইলোআমিও গিয়ে ঐ খানে শুয়ে পড়লামচারদিকে মানুষ ঘিরে ধরেছেকেউ কেউ আমার কাছে ঘটনা জানতে চাইলো....আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছিলনাএর মাঝে একজন সবাইকে ধমক দিয়ে সরিয়ে দিলসবার মাথায় পানি ঢালার ব্যাবস্থা করতে বললমামার হুশ হওয়ার পর আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল- ভাইগ্না বাইচ্যা আছ? আপা আমারে মাইরাই ফালতোএকে একে সবাই হুশ হলোআমি সব ঘটনা খুলে বললামএর মাঝে দেখি শরীফের আব্বাও লোক নিয়ে হাজিরকেউ কেউ নদীর পাড়ে যাওয়ার সাহস দেখালোশেষে আমি সবাইকে নিয়া নদীর পাড়ে গেলামনৌকা নাইআমরা স্রোতের অনুকুলে হেটে যাচ্ছিসবাই চিৎকার করে উঠল এই যে নৌকাদেখলাম শুধু কংকালটা আছেএর মাঝে একজন বলল দেখিতো মাটিতে রাক্ষসটার পায়ের দাগ আছে কিনা? আমরা নদীর পাড়ে কোন পায়ের দাগও পাইনি
শেষে ঐ কংকালটিই মাটি দেওয়া হলো

৩টি মন্তব্য: