শনিবার, ১০ জুলাই, ২০১০

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ই মে, ১৮৬১ - ৭ই আগস্ট, ১৯৪১) (২৫শে বৈশাখ, ১২৬৮ - ২২শে শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) বাংলার দিকপাল কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক। তিনি গুরুদেব, কবিগুরুবিশ্বকবি অভিধায় নন্দিত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেবাংলা সাহিত্যসংগীতে রবীন্দ্রনাথ এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেন। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন তিনি।[১] নোবেল ফাউন্ডেশন তাঁর এই কাব্যগ্রন্থটিকে বর্ণনা করেছিল একটি "গভীরভাবে সংবেদনশীল, উজ্জ্বল ও সুন্দর কাব্যগ্রন্থ" রূপে।[২]

রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছিল কলকাতার এক পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে।[৩][৪][৫][৬] মাত্র আট বছর বয়সে তিনি প্রথম কাব্যরচনায় প্রবৃত্ত হন।[৭] 1887 সালে মাত্র ষোলো বছর বয়সে "ভানুসিংহ" ছদ্মনামে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।[৮] প্রথম ছোটোগল্প ও নাটক রচনা করেন এই বছরেই। রবীন্দ্রনাথ ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। তাঁর মতাদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর বিচিত্র ও বিপুল সৃষ্টিকর্ম এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশ্বভারতীর মধ্য দিয়ে।

বঙ্গীয় শিল্পের আধুনিকীকরণে তিনি ধ্রুপদি ভারতীয় রূপকল্পের দূরুহতা ও কঠোরতাকে বর্জন করেন। নানান রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিষয়কে উপজীব্য করে রচিত হয়েছে তাঁর উপন্যাস, ছোটোগল্প, সংগীত, নৃত্যনাট্য, পত্রসাহিত্য ও প্রবন্ধসমূহ। তাঁর বহুপরিচিত গ্রন্থগুলির অন্যতম হল গীতাঞ্জলি, গোরা, ঘরে বাইরে, রক্তকরবী, শেষের কবিতা ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথের কাব্য, ছোটোগল্প ও উপন্যাস গীতিধর্মিতা, সহজবোধ্যতা, ধ্যানগম্ভীর প্রকৃতিবাদ ও দার্শনিক চিন্তাধারার জন্য প্রসিদ্ধ। তাঁর রচিত গান আমার সোনার বাংলাজনগণমন-অধিনায়ক জয় হে যথাক্রমে বাংলাদেশভারত রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত।

সৃষ্টিকর্ম

এই বিষয়ে মূল নিবন্ধের জন্য দেখুন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিকর্ম

Black-and-white close-up photograph of a piece of wood boldly painted in unmixed solid strokes of black and white in a stylized semblance to "ra" and "tha" from the Bengali syllabary.
কাঠের সিলে খোদিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামের আদ্যক্ষরদ্বয় ("র-ঠ")। প্রাচীন হাইদাখোদাই লিপির সঙ্গে এর শৈলীগত মিল লক্ষিত হয়। রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই তাঁর পাণ্ডুলিপিগুলিতে এই ধরনের নকশা অঙ্কন করতেন।[৬৭]

রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতাগুলির জন্য সর্বাধিক পরিচিত। এছাড়াও তিনি লিখেছেন উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছোটোগল্প, ভ্রমণ-আখ্যায়িকা, নাটক এবং দুই সহস্রাধিক গান। গদ্য রচনার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পগুলি সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয়। তাঁকে বাংলা ভাষায় ছোটোগল্পের প্রথম সার্থক রূপস্রষ্টাও মনে করা হয়। তাঁর রচনাবলি ছন্দোময়, আশাবাদী ও গীতিময়। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাই এই উপাখ্যানগুলির প্রধান উপজীব্য বিষয়।

[সম্পাদনা]কবিতা

Close-up of yellowed title page in an old book: "Gitanjali (Song Offerings) by Rabindranath Tagore. A collection of prose translations made by the author from the original Bengali with an introduction by W. B. Yeats. Macmillan and Co., Limited, St. Martin's Street, London, 1913."
গীতাঞ্জলি কাব্যের ম্যাকমিলান সংস্করণের প্রচ্ছদ, ১৯১৩

রবীন্দ্রনাথের কাব্য বহুবর্ণময়। তাঁর কাব্য কখনও রক্ষণশীল ধ্রুপদি শৈলীতে, কখনও হাস্যোজ্জ্বল লঘুতায়, কখনও বা দার্শনিক গাম্ভীরে, আবার কখনও বা আনন্দের উচ্ছ্বাসে মুখরিত। এই কাব্যগুলির উৎস পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে রচিতবৈষ্ণব কবিদের পদাবলি সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথের কাব্যে গভীর প্রভাব বিস্তার করেন উপনিষদ রচয়িতা ঋষিকবিগণ। এঁদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হলেন ব্যাস। এছাড়াও অতিন্দ্রীয়বাদী সুফি সন্ত কবীরভক্তিবাদী কবি রামপ্রসাদেরপ্রভাবও তাঁর কাব্যে লক্ষিত হয়।[৬৮] তবে রবীন্দ্রনাথের কবিতা সৃষ্টিশীলতা ও সৌকর্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় উপনীত হয়, গ্রামীণ বাংলার লোকসংগীতের সঙ্গে তাঁর পরিচিতি লাভের পরই। এই সময় লালন শাহ সহ বাংলার বিশিষ্ট বাউল সংগীতস্রষ্টাদের সান্নিধ্যে আসেন কবি।[৬৯][৭০] বাউল সংগীতকে পুনরাবিষ্কার করে জনপ্রিয় করে তুলতে রবীন্দ্রনাথ বিশেষ ভূমিকা নেন। এই সব বাউল গান উনিশ শতকের কর্তাভজাদের গানের মতো অন্তর্নিহিত দৈবসত্ত্বার অনুসন্ধান ও ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা ছিল।[৭১][৭২] শিলাইদহে অবস্থানকালে তাঁর গীতিকবিতার জন্য একটি শব্দবন্ধ তিনি গ্রহণ করেন বাউল পদাবলি থেকে - মনের মানুষ। ধ্যান করেন তাঁর জীবন দেবতা-র। প্রকৃতি ও মানবচরিত্রের আবেগময় নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে এই যোগসূত্রটি পরমসত্ত্বার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ভানুসিংহের নামাঙ্কিত কবিতাগুলিতেও কবি এই শৈলীর ব্যবহার ঘটান। রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলাকে উপজীব্য করে লেখা এই কবিতাগুলি পরবর্তী সত্তর বছরে বারংবার সংশোধন করেছিলেন কবি।[৭৩][৭৪]

১৯৩০-এর দশকে একাধিক পরীক্ষামূলক রচনায় তিনি বাংলা সাহিত্যে সদ্য আগত আধুনিকতা ও বাস্তবতাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।[৭৫] রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী জীবনে রচিত আফ্রিকাক্যামেলিয়া এই রকমই দুটি পরিচিত কবিতা। প্রথম দিকে সাধু ভাষায় কবিতা রচনা করলেও, পরবর্তীকালে কবিতার ভাষা হিসেবে বেছে নেনে মান্য চলিত বাংলাকে। তাঁর অন্যান্য প্রসিদ্ধ কাব্যগ্রন্থগুলি হল: মানসী, সোনার তরী, বলাকা[৭৬], ও পূরবী ইত্যাদি। সোনার তরী কবিতাটিতে কবি জীবন ও তার কীর্তির ক্ষণস্থায়ী অস্তিত্বের কথা বলেছেন। এই কবিতার শেষ পংক্তিদুটি অবিস্মরণীয় - "শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি/ যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।" সারা বিশ্বে রবীন্দ্রনাথের সর্বাপেক্ষা সুপরিচিত গ্রন্থটি হল গীতাঞ্জলি। এই কাব্যগ্রন্থটির জন্যই তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন।[৭৭] নিচে গীতাঞ্জলিকাব্যের ১২৫ সংখ্যক গানটি উদ্ধৃত হল:

Three-verse handwritten composition; each verse has original Bengali with English-language translation below: "My fancies are fireflies: specks of living light twinkling in the dark. The same voice murmurs in these desultory lines, which is born in wayside pansies letting hasty glances pass by. The butterfly does not count years but moments, and therefore has enough time."
রবীন্দ্রনাথের হস্তাক্ষর; ১৯২৬ সালে হাঙ্গেরিতে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় লিখিত।

আমার এ গান ছেড়েছে তার সকল অলংকার
তোমার কাছে রাখেনি আর সাজের অহংকার।
অলংকার যে মাঝে প’ড়ে
মিলনেতে আড়াল করে,
তোমার কথা ঢাকে যে তার মুখর ঝংকার।

তোমার কাছে খাটে না মোর কবির গরব করা–
মহাকবি, তোমার পায়ে দিতে চাই যে ধরা।
জীবন লয়ে যতন করি
যদি সরল বাঁশি গড়ি,
আপন সুরে দিবে ভরি সকল ছিদ্র তার।

এই কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ করেন রবীন্দ্রনাথই (Gitanjali, verse VII):[৭৮]

"My song has put off her adornments. She has no pride of dress and decoration. Ornaments would mar our union; they would come between thee and me; their jingling would drown thy whispers."
"My poet's vanity dies in shame before thy sight. O master poet, I have sat down at thy feet. Only let me make my life simple and straight, like a flute of reed for thee to fill with music."

[সম্পাদনা]ছোটোগল্প

Ink illustration of a tousled-haired boy seated outside and holding a lance-stick and playing with a wheeled red toy horse; in the background, a large blue palanquin and tackle with a carrying pole projecting out of it.
১৯১৩ সালে ম্যাকমিলান প্রকাশিত দ্য ক্রেসেন্ট মুন (শিশু ভোলানাথ) অনুবাদগ্রন্থের দ্য হিরো (বীরপুরুষ) আখ্যানকবিতার নন্দলাল বসুকৃত অলংকরণ

রবীন্দ্রনাথের জীবনের "সাধনা" পর্বটি (১৮৯১–৯৫) ছিল সর্বাপেক্ষা সৃষ্টিশীল পর্যায়। তাঁর গল্পগুচ্ছগল্পসংকলনের প্রথম তিন খণ্ডের চুরাশিটির গল্পের অর্ধেকই রচিত হয় এই সময়কালের মধ্যে।[১৮] এইসব গল্পে পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলির প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে। আধুনিক ধ্যানধারণা সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করেছেন তিনি। আবার কখনও মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের বৌদ্ধিক বিশ্লেষণকে করে তুলেছেন গল্পের মূল উপজীব্য। "সাধনা" পর্বে রচিত প্রথম দিককার গল্পগুলিকে রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন এক স্বতঃস্ফূর্ত জীবনীশক্তির বহিঃপ্রকাশ। পতিসর, সাজাদপুর ও শিলাইদহ সহ পারিবারিক জমিদারির বিভিন্ন অংশে ঘুরে সাধারণ গ্রামবাসীদের সঙ্গে মেলামেশা করে তাদের জীবন থেকেই এই সব গল্পের উপাদান সংগ্রহ করেন রবীন্দ্রনাথ।[১৮] সমকালীন ভারতের দরিদ্র জনগণের জীবনের প্রতি এক গভীর অন্তদৃষ্টি এই সব গল্পে নিহিত হয়ে আছে। আর তাই গল্পগুলি ভারতীয় সাহিত্যে একক স্থানের অধিকারী।[৭৯]

"কাবুলিওয়ালা" এক শহুরে লেখকের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা এক কাবুলি মেওয়াওয়ালার গল্প। এই গল্পের একস্থানে ফুটে উঠেছে ভারতের বদ্ধ নগরজীবন থেকে ছুটি নিয়ে সুদূর বনপর্বতে মুক্ত স্বাধীন জীবনযাপনের এক আকূল আকাঙ্ক্ষা: "এখন শুভ্র শরৎকাল। প্রাচীনকালে এই সময়ে রাজারা দিগ্‌বিজয়ে বাহির হইতেন। আমি কলিকাতা ছাড়িয়া কখনো কোথাও যাই নাই, কিন্তু সেই জন্যই আমার মনটা পৃথিবীময় ঘুরিয়া বেড়ায়। আমি যেন আমার ঘরের কোণে চিরপ্রবাসী, বাহিরের পৃথিবীর জন্য আমার সর্বদা মন কেমন করে। একটা বিদেশের নাম শুনিলেই অমনি আমার চিত্ত ছুটিয়া যায়, তেমনি বিদেশী লোক দেখিলেই অমনি নদী পর্বত অরণ্যের মধ্যে একটা কুটিরের দৃশ্য মনে উদয় হয়, এবং একটা উল্লাসপূর্ণ স্বাধীন জীবনযাত্রার কথা কল্পনায় জাগিয়া ওঠে।"[৮০] গল্পগুচ্ছ সংকলনের অন্য গল্পগুলির অনেকগুলিই রচিত হয়েছিল রবীন্দ্রজীবনের সবুজ পত্র পর্বে (১৯১৪–১৭; প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত পত্রিকার নামানুসারে) [১৮]

A warm-toned ink work, dominated by orange-red (foreground) and olive green (background wall) showing a shawl- and sari-clad woman with a young child, who holds a book, in her lap.
দ্য ক্রেসেন্ট মুন(১৯১৩) গ্রন্থের দ্য বিগিনিংকবিতার অসিতকুমার হালদার কৃত অলংকরণ

রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ বাংলা কথাসাহিত্যের এক অন্যতম জনপ্রিয় গ্রন্থ। এই গ্রন্থের একাধিক গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র ও নাটক। সত্যজিৎ রায়ের চারুলতা রবীন্দ্রনাথের বিতর্কিত ছোটোগল্প (মতান্তরে অনু-উপন্যাস)নষ্টনীড় অবলম্বনে নির্মিত। চলচ্চিত্রায়িত অপর একটি ছোটোগল্প হল অতিথি। এই গল্পে এক গ্রাম্য জমিদারের সঙ্গে নৌকায় সাক্ষাৎ হয় তারাপদ নামে এক ব্রাহ্মণ বালকের। ছেলেটি জানায় সে বাড়ি থেকে পালিয়ে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দয়াপরবশ হয়ে জমিদার তাকে দত্তক নেয় এবং শেষ পর্যন্ত আপন কন্যার সঙ্গে ছেলেটির বিবাহ দিতে উদ্যোগী হন। কিন্তু বিয়ের আগের রাতেই আবার পালিয়ে যায় তারাপদ। স্ত্রীর পত্র গল্পটি বাংলা সাহিত্যে নারী স্বাধীনতার স্বপক্ষে লেখা একটি প্রথম যুগের সাহসী পদক্ষেপ। একটি চিরন্তন পুরুষতান্ত্রিক মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের গৃহবধূ মৃণাল পুরী ভ্রমণের সময় একটি চিঠি লেখে। এই চিঠিতেই প্রকাশিত হয়েছে সমগ্র গল্পটি। নিজের জীবনের সব সংগ্রাম ও বঞ্চনার উল্লেখ করে শেষাবধি গৃহে না ফেরার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে সে। স্বামীকে সে জানিয়ে দেয়, আমিও বাঁচবো, এই বাঁচলুম

হৈমন্তী গল্পে রবীন্দ্রনাথ আঘাত করেছেন হিন্দু বিবাহ সংস্কার ও ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভণ্ডামিকে। তুলে ধরেছেন বিবাহিত বাঙালি রমণীর জীবন্মৃত অবস্থাটি। দেখিয়েছেন কেমন করে হৈমন্তী নামে এক সংবেদনশীল যুবতীকে তার স্বাধীনতাস্পৃহার জন্য শেষ পর্যন্ত প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়। এই গল্পের শেষ লাইনে গল্পকার সরাসরি রামের জন্য সীতার আত্মত্যাগের হিন্দু আদর্শটিকে আক্রমণ করেন। মুসলমানীর গল্প নামক গল্পটিতে হিন্দু-মুসলমান বিরোধের মূল কারণগুলি অনুসন্ধান করেছেন রবীন্দ্রনাথ। অন্যদিকে দর্পহরণ গল্পে এক সাহিত্যিক-খ্যাতিলোভী উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবকের চিত্র এঁকে তিনি তাঁর আত্মসচেতনারই পরিচয় দেন। স্ত্রীকে ভালবাসলেও এই যুবক স্ত্রীর নিজস্ব সাহিত্যিক সত্ত্বাটিকে রুদ্ধ করতে চায়। কারণ তার মতে সাহিত্য নারীসুলভ নয়। জানা যায়, কৈশোর ও প্রথম যৌবনে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং নারী সম্পর্কে এই রকম ধারণাই পোষণ করতেন। তবে দর্পহরণ গল্পে শেষ পর্যন্ত উক্ত যুবকটি তার স্ত্রীর প্রতিভা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়। রবীন্দ্রনাথের অনেক ছোটোগল্পের শেষ লাইন বাংলা ভাষায় প্রবাদপ্রতিম। এগুলি মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য জীবিত ও মৃত গল্পটির সমাপ্তি: কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই।

[সম্পাদনা]উপন্যাস

রবীন্দ্রনাথ মোট তেরোটি উপন্যাস রচনা করেন: বৌ-ঠাকুরাণীর হাট, রাজর্ষি, চোখের বালি, নৌকাডুবি, প্রজাপতির নির্বন্ধ, গোরা, ঘরে-বাইরে, চতুরঙ্গ,যোগাযোগ, শেষের কবিতা, দুই বোন, মালঞ্চচার অধ্যায়ঘরে-বাইরে উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উত্থান, চরমপন্থী আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলনের ধর্মীয় অনুষঙ্গ ইত্যাদির বিরোধিতা করেন। আদর্শবাদী জমিদার নিখিলেশের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা এই উপন্যাসটি ছিল রবীন্দ্রনাথের একটি দ্বান্দ্বিক ভাবাবেগের প্রকাশ্যকথন। ১৯১৪ সালের একটি মানসিক অবসাদ ছিল এই উপন্যাসের উৎস। হিন্দু-মুসলমানের একটি দাঙ্গা ও তার প্রেক্ষিতে নিখিলের আহত হওয়ার (সম্ভবত শারীরিকভাবে) ঘটনার মাধ্যমে উপন্যাসের সমাপ্তি।[৮১] একইভাবে, গোরা উপন্যাসেও উত্থাপিত হয়েছিল ভারতীয়ত্ব সংক্রান্ত বিতর্কিত প্রশ্নগুলি। তবে ঘরে-বাইরে উপন্যাসে জাতিপরিচয়, ব্যক্তিস্বাধীনতা, ও ধর্মীয় প্রসঙ্গ একটি পারিবারিক কাহিনি ও ত্রিকোণ প্রেমের উপাখ্যানের আধারে গড়ে উঠেছে।[৮২]

যোগাযোগ উপন্যাসে নায়িকা কুমুদিনী শিব-সতীর আদর্শে অনুপ্রাণিত। একদিকে প্রগতিবাদী ও স্নেহপ্রবণ দাদার অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও অবসাদ এবং অন্যদিকে নিজের অত্যাচারী, দাম্ভিক ও পুরুষতান্ত্রিকতায় ঘোর বিশ্বাসী স্বামী – এই দুয়ের টানাপোড়েনে মানসিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত সে। এই উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি তুলে ধরেছেন। একাধিক প্যাথো ব্যবহার করে দেখিয়েছেন, কিভাবে বাঙালি রমণীর উভয়সংকটাবস্থা এবং নিয়তির নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে তাদের গর্ভাবস্থা, কর্তব্য ও পারিবারিক সম্মান। একই সঙ্গে বাংলার ভূমিকেন্দ্রিক সামন্ততন্ত্রের পতনের পূর্বাভাষও মেলে এই উপন্যাস থেকে।[৮৩]

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: সেরেনবার্গ গৃহীত ফটোগ্রাফ

শেষের কবিতা রবীন্দ্রনাথের সর্বাপেক্ষা কাব্যময় উপন্যাস। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অমিত রায় একজন কবি। অমিতের রচিত কবিতা ও কাব্যময় পংক্তিগুলি স্থান পেয়েছে উপন্যাসের পাতায় পাতায়। আবার ব্যঙ্গ ও উত্তর-আধুনিকতার নানা উপাদানের সন্ধানও মেলে এই উপন্যাসে। নির্বিকার চরিত্রগুলি এখানে ঘটনাচক্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামে এক বৃদ্ধ, সেকেলে এবং বিরক্তিকরভাবে খ্যাতনামা এক কবির খ্যাতিকে আঘাত করেছে। রবীন্দ্রনাথের রচনা হিসেবে তাঁর উপন্যাসগুলি কম প্রশংসা অর্জন করলেও এগুলি অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলি অবশ্য মননশীল সমাজের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এই চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সত্যজিৎ রায়ের ঘরে বাইরেঋতুপর্ণ ঘোষের চোখের বালি। এই সব চলচ্চিত্রের সাউন্ডট্র্যাকে প্রায়শই ব্যবহৃত হয়েছে নানা রবীন্দ্রসংগীত

একটি অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ করছেন বিশিষ্ট অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়; রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ও গল্প অবলম্বনে নির্মিত বহু চলচ্চিত্রে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র।

[সম্পাদনা]প্রবন্ধ-নিবন্ধ

কথাসাহিত্যের বাইরেও গদ্যকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথের একটি বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। পনেরো বছর বয়স থেকে জীবনের শেষ বছর পর্যন্ত রচনা করেছেন অসংখ্য গদ্য ও প্রবন্ধ। এগুলির বিষয়বস্তু সাহিত্য সমালোচনা, রাজনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা ও দর্শন। এছাড়াও রয়েছে ভ্রমণ-বিবরণ, পত্রাবলি এবং ব্যক্তিগত আবেগধর্মী রচনাও। প্রাচীন সাহিত্য(১৯০৭), লোকসাহিত্য (১৯০৭), সাহিত্য (১৯০৭), আধুনিক সাহিত্য (১৯০৭) ও সাহিত্যের পথে (১৯১১) প্রবন্ধ সংকলনে ভারতীয় অধ্যাত্মবিশ্বাসের সত্য, সুন্দর ও শিবের সম্মিলনের আদর্শকেই সাহিত্যের প্রাণবস্তুরূপে গ্রহণ করে তারই আলোকে সাহিত্যের মূল্য নির্ধারণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। অন্যদিকে আত্মশক্তি (১৯০৫), ভারতবর্ষ (১৯০৬), কালান্তর (১৯০৭), রাজাপ্রজা (১৯০৮), স্বদেশ (১৯০৮),সমাজ (১৯০৮), ধর্ম (১৯০৯), মানুষের ধর্ম (১৯৩৩) ও শান্তিনিকেতন (১৯৩৫) ইত্যাদি প্রবন্ধসংকলনে রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, শিক্ষা প্রভৃতি সকল বিষয়েই উদার ও সর্বজনীন মানবতার আদর্শটিকে গ্রহণ করেছেন তিনি। পঞ্চভূত (১৮৯৭), বিচিত্র প্রবন্ধ (১৯০৭), জীবনস্মৃতি (১৯১২), লিপিকা (১৯২২) প্রভৃতি ব্যক্তিগত আবেগধর্মী প্রবন্ধগুলির সার্থকতা বিষয়বস্তুর মহিমায় নয়, বরং এক গভীর রসব্যঞ্জনায়। বিশ্বের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ছিল রবীন্দ্রনাথের আত্মসাধনার একটি অংশ। এই সব ভ্রমণের বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ রয়েছেয়ুরোপ প্রবাসীর পত্র (১৮৮১), য়ুরোপ যাত্রীর ডায়েরি (১৮৯২-৯৩), জাপান যাত্রী (১৯১৯), যাত্রী (১৯১৯),রাশিয়ার চিঠি (১৯১৩), পারস্যে (১৯৩৬) ইত্যাদি গ্রন্থে। আবার ব্যক্তিসম্পর্কের ক্ষেত্রে কবির হৃদয়াবেগ ও অন্তরঙ্গতার এক আশ্চর্য দলিল তাঁর পত্রসাহিত্য:ছিন্নপত্র, ভানুসিংহের পত্রাবলীপথে ও পথের প্রান্তে এবং উনিশ খণ্ডে প্রকাশিত চিঠিপত্র

[সম্পাদনা]নাটক

রবীন্দ্রনাথের নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর মলিএর-এর লা বুর্জোয়া জাঁতিরোম অবলম্বনে রচনা করেছিলেন বাংলা নাটক হঠাৎ নবাব। মাত্র ষোলো বছর বয়সে এই নাটকের মুখ্য ভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমে নাট্যজগতে প্রবেশ করেন রবীন্দ্রনাথ।[৮৪] কুড়ি বছর বয়সে রচনা করেন প্রথম গীতিনাট্য বাল্মীকি প্রতিভাকৃত্তিবাসি রামায়ণের উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত এই গীতিনাট্যটির মূল উপজীব্য ছিল দেবী সরস্বতীর কৃপায় দস্যু রত্নাকরের মহাকবি বাল্মীকি হয়ে ওঠার কাহিনি।[৮৫] এই নাটকে বিভিন্ন নাট্যশৈলী নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালান রবীন্দ্রনাথ। গানের ক্ষেত্রে যেমন কীর্তনের একটি আধুনিক রূপ প্রয়োগ করেন, তেমনই দস্যুসংগীতের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন ঐতিহ্যশালী ব্রিটিশ ও আইরিশ লোকসংগীতের সুর।[৮৬] তাঁর অপর এক উল্লেখযোগ্য নাটক ডাকঘর-এ কিভাবে একটি শিশু বদ্ধ পরিবেশ থেকে মুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে শেষ পর্যন্ত ঘুমিয়ে পড়ে (সম্ভবত এটি মৃত্যুর রূপক)। এই নাটকটি সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ইউরোপে নাটকটি অত্যন্ত প্রশংসিত হয়। এই নাটকে মৃত্যু রবীন্দ্রনাথের কথায়, সঞ্চিত ধন ও শাস্ত্রীয় অনুশাসনময় বিশ্ব থেকে আধ্যাত্মিক মুক্তির প্রতীক।[৮৭][৮৮] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোলিশ ডাক্তার ও শিক্ষাবিদ জানুজ কোর্কজ্যাক ওয়ারশো ঘেটোতে তাঁর অধীনে থাকা অনাথ শিশুদের অভিনয়ের জন্যডাকঘর-এর ইংরেজি অনুবাদ দ্য পোস্ট অফিস-কে বেছে নেন। নাটকটি অভিনীত হয় ১৯৪২ সালের ১৮ জুলাই। এর তিন সপ্তাহের মধ্যেই এই শিশুদেরট্রেবলিঙ্কা এক্সটার্মিনেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ড. কোর্কজ্যাকের ইংরেজি জীবনীকার বেটি জিন লিফটন দ্য কিং অফ চিলড্রেন গ্রন্থে লিখেছেন যে ড. কোর্কজ্যাক প্রকৃতপক্ষে এই অনাথ শিশুদের মৃত্যুর সঙ্গে পরিচিত করতে তুলতেই এই পরিকল্পনা নিয়েছিলেন।

কাব্যময়তা ও আবেগময় ছন্দকে কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু করে তিনি যে নতুন ধরনের নাট্যরীতির প্রবর্তন করেন, বাংলা নাটকে তা ইতিপূর্বে ছিল না। রবীন্দ্রনাথ নিজে এগুলিকে ক্রিয়ার নাটকের বদলে অনুভূতির নাটক বলেছেন। ১৮৯০ সালে রচিত বিসর্জন নাটকটি ছিল তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকীর্তি।[৮৫] এই নাটকের বৈশিষ্ট্য ছিল এক জটিল উপকাহিনির জালিকা এবং বিস্তারিত স্বগতোক্তি। পরবর্তীকালে তাঁর নাটকগুলি দার্শনিক ও রূপক নাট্যবস্তুর ভিত্তিতে রচিত হতে থাকে।ডাকঘর এই শ্রেণিরই নাটক। আবার এক প্রাচীন বৌদ্ধ উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত চণ্ডালিকা নাটকে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন কিভাবে গৌতম বুদ্ধের শিষ্য আনন্দএক অস্পৃশ্য আদিবাসী কন্যার হাত থেকে জল গ্রহণ করেন।[৮৯] রক্তকরবী নাটকে আছে কেবলমাত্র নিজেকে সমৃদ্ধ করে তোলায় নেশায় আচ্ছন্ন এক রাজা কিভাবে তাঁর প্রজাদের খনিতে কাজ করতে বাধ্য করাচ্ছেন, তার চিত্র। এই নাটকের নায়িকা নন্দিনী সাধারণ মানুষকে একত্রিত করে এই সব দাসত্বের চিহ্ন ধ্বংস করে দেয়। রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হল: চিত্রাঙ্গদা, রাজা, মায়ার খেলা, মুক্তধারা, অচলায়তন, শারদোৎসব, তাসের দেশ ইত্যাদি।


মিডিয়া ফায়ার থেকে

বি গুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর এর লেখা বই গুলো ডাউনলোড করুন একদম ফ্রি


4shared থেকে ফ্রি ডাউনলোড করুন রবিন্দ্র নাথ ঠাকুরের আরো কিছু বই
Bodnam-Rabindranath Tagore.pdf Chhuti-Rabindranath Tagore.pdf Choraidhon-Rabindranath Tagore.pdf Chotoboro-Rabindranath Tagore.pdf Denapawna_Rabindranath_Tagore.pdf Didi-Rabindranath Tagore.pdf Dorpohoron-Rabindranath Tagore.pdf Khoka Babur Prottaborton-Rabindranath Tagore.pdf বোষ্টমি By রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf ভিকারীনি By রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf

*তথ্য এবং ছবি সংগ্রহ Wikipedia

৯টি মন্তব্য:

  1. কোন মন্তব্য নাই?

    উত্তরমুছুন
  2. কবির নামের বানানটাই ভুল করলেন শিরোনামে!

    আর কবি নিজের নাম ইংরেজীতে সবসময় Tagore লিখেছেন, কাজেই আপনি সেখানে Thakur লিখতে পারেন না।

    আর সব তথ্য বাংলা উইকিপিডিয়া থেকে হুবহু তুলে দিয়েছেন। নিজের কিছুও দিন।

    উত্তরমুছুন
  3. ঠাকুরকে বিদ্রুপ করে লেখা রবিন্দ্রাথের কবিতাটি চাই। আমার ইমেইল হল- imamul.hazari1976@gmail.com

    উত্তরমুছুন
  4. ভাল জিনিশ। আমার কাজে লাগব। ধন্যবাদ...

    উত্তরমুছুন
  5. খুব ভালো একটা ব্লগ, আমার অনেক উপকারে আসলো। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন
  6. কই ডাউনলোড হয়নাতো .....................!???

    উত্তরমুছুন
  7. নামানো যাচ্ছে না।
    "This file is currently set to private.When a resource is set to private by its owner, only the owner can access it."

    উত্তরমুছুন